স্টোর অফ ভ্যালু (Store of Value) কি? অর্থনীতিতে মূল্য সংরক্ষণের ধারণা

Store of value

স্টোর অফ ভ্যালু (Store of Value) অর্থনীতি, ফাইন্যান্স এবং মুদ্রাবিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা। এটি এমন একটি সম্পদ বা অ্যাসেটকে বোঝায় যা সময়ের সাথে তার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা (purchasing power) সংরক্ষণ করতে পারে, যাতে এটি ভবিষ্যতে ব্যবহার বা বিনিময়ের জন্য উপযোগী থাকে। এই ধারণাটি অর্থের (money) তিনটি প্রধান ফাংশনের একটি—অন্য দুটি হলো মিডিয়াম অফ এক্সচেঞ্জ (Medium of Exchange) এবং ইউনিট অফ অ্যাকাউন্ট (Unit of Account)।  

 ১. সংজ্ঞা এবং মৌলিক ধারণা

স্টোর অফ ভ্যালু (Store of Value) হলো এমন একটি সম্পদ যা বর্তমানে অর্জিত মূল্যকে ভবিষ্যতে সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ, যদি আপনি আজ একটি সম্পদ কিনেন বা সঞ্চয় করেন, তাহলে সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও তার মূল্য কম না হয়ে বা অদৃশ্য না হয়ে থাকা উচিত। এটি অর্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাংশন, কারণ এর মাধ্যমে লোকেরা সঞ্চয় (savings), বিনিয়োগ (investment) এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা (risk management) করে।

 

কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? মানুষের জীবনচক্রে (life cycle) আয় অসমান হয়—যৌবনে আয় বেশি, বার্ধক্যে কম। স্টোর অফ ভ্যালু এই অসমতাকে সামলাতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও এটি অপরিহার্য, কারণ এটি ইনফ্লেশন (inflation) বা ডিফ্লেশন (deflation) এর মতো ফ্যাক্টর থেকে মূল্য রক্ষা করে।

সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা: কোনো সম্পদকে পরিপূর্ণ স্টোর অফ ভ্যালু বলা যায় না, কারণ সময়ের সাথে সবকিছুর মূল্য পরিবর্তিত হয়। তবে যতটা সম্ভব স্থিতিশীলতা থাকলে তা ভালো স্টোর অফ ভ্যালু। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইন্স (John Maynard Keynes) এবং মিল্টন ফ্রিডম্যান (Milton Friedman) এর মতো চিন্তাবিদরা এটিকে অর্থের স্থিতিশীলতার সাথে যুক্ত করেছেন।

 

 ২. ভালো স্টোর অফ ভ্যালুর (Store of Value) বৈশিষ্ট্য

একটি সম্পদকে কার্যকর স্টোর অফ ভ্যালু (Store of Value) হিসেবে গণ্য করার জন্য নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। এগুলো অর্থের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়, কিন্তু স্টোর অফ ভ্যালুর ক্ষেত্রে মূল্যের স্থিতিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ:

 

দীর্ঘস্থায়িত্ব (Durability): সম্পদটি সময়ের সাথে নষ্ট বা ক্ষয় না হয়। উদাহরণ: সোনা নষ্ট হয় না, কিন্তু ফলমূল নষ্ট হয়ে যায়।

বহনযোগ্যতা (Portability): সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। উদাহরণ: কাগজের টাকা বা ডিজিটাল কারেন্সি সহজে বহনযোগ্য, কিন্তু একটি বাড়ি নয়।

বিভাজ্যতা (Divisibility): ছোট ছোট অংশে ভাগ করা যায়, যাতে ছোট লেনদেনও সম্ভব হয়। উদাহরণ: সোনাকে গ্রামে ভাগ করা যায়।

পরস্পর বিনিময়যোগ্যতা (Fungibility): একটি ইউনিট অন্যটির সাথে সমান মূল্যের এবং বিনিময়যোগ্য। উদাহরণ: একটি ১০০ টাকার নোট অন্যটির মতোই।

দুর্লভতা (Scarcity): সীমিত সরবরাহ, যাতে অতিরিক্ত উৎপাদন মূল্য কমাতে না পারে। উদাহরণ: সোনার সরবরাহ সীমিত।

স্বীকৃতি (Acceptability): সাধারণভাবে লোকেরা এটিকে মূল্যবান হিসেবে স্বীকার করে। এটি সামাজিক এবং আইনি সমর্থনের উপর নির্ভর করে।

মূল্যের স্থিতিশীলতা (Stability of Value): সময়ের সাথে মূল্যের ওঠানামা কম। ইনফ্লেশন বা অর্থনৈতিক সংকটে এটি প্রভাবিত হয় না।

নিরাপত্তা (Security): চুরি, ক্ষয় বা জালিয়াতি থেকে সুরক্ষিত। উদাহরণ: ব্যাঙ্ক ডিপোজিট বা ক্রিপ্টো ওয়ালেট।

 

এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে কোনো একটি দুর্বল হলে সম্পদটির স্টোর অফ ভ্যালু ক্ষমতা কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, হাইপারইনফ্লেশন (hyperinflation) এর সময় ফিয়াট কারেন্সির মূল্যের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়।

 

 ৩. স্টোর অফ ভ্যালুর উদাহরণ

স্টোর অফ ভ্যালু বিভিন্ন রূপে থাকতে পারে। নীচে কয়েকটি শ্রেণীবিভাগ সহ উদাহরণ দেওয়া হলো:

 

প্রথাগত অর্থ (Fiat Currency): যেমন ডলার, টাকা, ইউরো। এগুলো সরকারের সমর্থনে স্থিতিশীল, কিন্তু ইনফ্লেশনের কারণে দীর্ঘমেয়াদে মূল্য হারায়। উদাহরণ: যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে “সেফ হ্যাভেন” বলা হয়।

ধাতু (Commodities): সোনা (gold) এবং রুপা (silver) সবচেয়ে ক্লাসিক উদাহরণ।  অন্যান্য: প্ল্যাটিনাম, তেল (কিন্তু তেলের মূল্য অস্থির)।

রিয়েল এস্টেট (Real Estate): জমি, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট। এগুলো ইনফ্লেশনের বিরুদ্ধে হেজ (hedge) হিসেবে কাজ করে, কিন্তু বহনযোগ্য নয় এবং মার্কেট ফ্লাকচুয়েশনের শিকার।

ফাইন্যান্শিয়াল অ্যাসেট (Financial Assets): স্টক (stocks), বন্ড (bonds), মিউচুয়াল ফান্ড। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে মূল্য বাড়াতে পারে, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ। উদাহরণ: ট্রেজারি বন্ড (Treasury Bonds) স্থিতিশীল।

ডিজিটাল অ্যাসেট (Digital Assets): ক্রিপ্টোকারেন্সি যেমন বিটকয়েন (Bitcoin)। বিটকয়েনকে “ডিজিটাল গোল্ড” বলা হয় কারণ এর সরবরাহ সীমিত (মোট ২১ মিলিয়ন কয়েন) এবং ডিসেন্ট্রালাইজড। অন্যান্য: ইথেরিয়াম, স্টেবলকয়েন (যেমন USDT, যা ডলারের সাথে পেগড)।

অন্যান্য: শিল্পকর্ম (art), ওয়াইন, কালেকটিবলস (collectibles) যেমন স্ট্যাম্প বা কয়েন। এগুলো দুর্লভতার কারণে মূল্য ধরে রাখে, কিন্তু লিকুইডিটি (liquidity) কম।

 

 ৪. ইতিহাস এবং বিবর্তন

স্টোর অফ ভ্যালুর ধারণা মানব সভ্যতার শুরু থেকেই আছে:

 

প্রথাগত সমাজ (Prehistoric Era): কাউরি শেল (cowrie shells), লবণ (salt), পশু (livestock)। লবণ থেকে “স্যালারি” (salary) শব্দটি এসেছে, কারণ রোমান সৈন্যদের লবণ দিয়ে বেতন দেওয়া হতো।

প্রাচীন যুগ (Ancient Times): ধাতুমুদ্রা (metallic coins) যেমন সোনা-রুপার কয়েন। লিডিয়া (Lydia) সভ্যতায় (৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) প্রথম কয়েন তৈরি হয়।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ: কাগজের টাকা (paper money) চীনে (৭ম শতাব্দী) শুরু হয়। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড (Gold Standard) ১৯শ শতাব্দীতে জনপ্রিয়, যেখানে কারেন্সি সোনার সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালে নিক্সন শক (Nixon Shock) এর পর ফিয়াট কারেন্সি শুরু হয়।

আধুনিক যুগ: ডিজিটালাইজেশনের সাথে ক্রিপ্টোকারেন্সি (২০০৯ সালে বিটকয়েন)। কোভিড-১৯ মহামারীতে (২০২০-২০২২) ইনফ্লেশনের কারণে সোনা এবং ক্রিপ্টোর চাহিদা বেড়েছে।

বিবর্তনের কারণ: প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক সংকট (যেমন ১৯২৯ এর গ্রেট ডিপ্রেশন বা ২০০৮ এর ফাইন্যান্শিয়াল ক্রাইসিস) এবং গ্লোবালাইজেশন এটিকে প্রভাবিত করেছে।

 

 ৫. সুবিধা এবং অসুবিধা

– সুবিধা:

  – সঞ্চয়ের সুবিধা: ভবিষ্যতের জন্য মূল্য রক্ষা করে, যেমন রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং।

  – ইনফ্লেশন হেজ: সোনা বা রিয়েল এস্টেট ইনফ্লেশনের বিরুদ্ধে রক্ষা করে।

  – অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ভালো স্টোর অফ ভ্যালু অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখে।

  – বৈচিত্র্যকরণ (Diversification): বিভিন্ন অ্যাসেটে বিনিয়োগ করে ঝুঁকি কমানো যায়।

 

– অসুবিধা:

  – ইনফ্লেশনের প্রভাব: ফিয়াট কারেন্সি মূল্য হারায় (যেমন, ভেনেজুয়েলায় হাইপারইনফ্লেশন ২০১৮ সালে ১ মিলিয়ন শতাংশ ছাড়িয়েছে)।

  – অস্থিরতা (Volatility): ক্রিপ্টোর মতো অ্যাসেটের মূল্য দ্রুত ওঠানামা করে (বিটকয়েন ২০২২ সালে ৭০% কমেছে)।

  – স্টোরেজ এবং সুরক্ষা খরচ: সোনা রাখতে ভল্ট দরকার, ক্রিপ্টোতে হ্যাকিং ঝুঁকি।

  – লিকুইডিটি সমস্যা: রিয়েল এস্টেট বিক্রি করতে সময় লাগে।

  – রেগুলেটরি ঝুঁকি: সরকারি নিয়ম (যেমন ক্রিপ্টো ব্যান) মূল্য প্রভাবিত করে।

 

 ৬. প্রভাবকারী ফ্যাক্টর

ইনফ্লেশন/ডিফ্লেশন: ইনফ্লেশন মূল্য কমায়, ডিফ্লেশন বাড়ায়।

সুদের হার (Interest Rates): উচ্চ সুদে ব্যাঙ্ক ডিপোজিট ভালো হয়।

অর্থনৈতিক সংকট: যুদ্ধ বা মহামারীতে সোনা বা ডলারের চাহিদা বাড়ে।

প্রযুক্তি: ব্লকচেইন ক্রিপ্টোকে নতুন স্টোর অফ ভ্যালু বানিয়েছে।

সামাজিক ফ্যাক্টর: বিশ্বাস (trust)—যেমন, ডলারের মূল্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর নির্ভর করে।

পরিবেশগত ফ্যাক্টর: জলবায়ু পরিবর্তন রিয়েল এস্টেট বা কমোডিটির মূল্য প্রভাবিত করতে পারে।

 

 ৭. আধুনিক প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যত

আজকের বিশ্বে স্টোর অফ ভ্যালু ডিজিটাল হয়ে উঠছে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি (CBDC) যেমন চায়নার ডিজিটাল ইউয়ান, ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণ করে স্টোর অফ ভ্যালু হিসেবে কাজ করতে পারে। ক্রিপ্টো মার্কেট ২০২৫ সালে (বর্তমান তারিখ অনুসারে) ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, কিন্তু রেগুলেশন (যেমন EU এর MiCA আইন) এটিকে প্রভাবিত করছে। ভবিষ্যতে AI এবং টোকেনাইজড অ্যাসেট (tokenized assets) নতুন সুযোগ তৈরি করবে, কিন্তু সাইবার সিকিউরিটি ঝুঁকি বাড়বে।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *