প্রুফ অফ স্টেক কী? সুবিধা ও অসুবিধা

proof of stake

প্রুফ অফ স্টেক (Proof of Stake, PoS) হলো একটি ঐকমত্য প্রক্রিয়া (Consensus Mechanism) যা ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে ট্রানজ্যাকশন যাচাই এবং নতুন ব্লক তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্রুফ অফ ওয়ার্ক (Proof of Work, PoW)-এর একটি বিকল্প, যা বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি দ্বারা ব্যবহৃত হয়। প্রুফ অফ স্টেক শক্তি খরচ কমায় এবং দ্রুত ও দক্ষতার সাথে নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। নিচে প্রুফ অফ স্টেক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

প্রুফ অফ স্টেক কী?

প্রুফ অফ স্টেক হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের ভ্যালিডেটররা (নোড বা অংশগ্রহণকারী) তাদের ধারণকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সির পরিমাণ (স্টেক) এবং নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে নতুন ব্লক তৈরি ও ট্রানজ্যাকশন যাচাই করে। এই প্রক্রিয়ায়, যার কাছে বেশি কয়েন বা টোকেন স্টেক করা থাকে, তার নতুন ব্লক তৈরির সম্ভাবনা বেশি হয়। এটি প্রুফ অফ ওয়ার্কের মতো কম্পিউটেশনাল শক্তির পরিবর্তে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে।

প্রুফ অফ স্টেক কীভাবে কাজ করে?

প্রুফ অফ স্টেক সিস্টেমে নিম্নলিখিত ধাপগুলোর মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন হয়:

1. স্টেকিং (Staking): অংশগ্রহণকারীরা তাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি (কয়েন বা টোকেন) একটি নির্দিষ্ট ওয়ালেটে লক করে। এই প্রক্রিয়াকে স্টেকিং বলা হয়। স্টেক করা কয়েনের পরিমাণ এবং স্টেকিংয়ের সময়কাল ভ্যালিডেটর নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

2. ভ্যালিডেটর নির্বাচন: নেটওয়ার্ক একটি অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ভ্যালিডেটর নির্বাচন করে। এই নির্বাচন সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে:

– স্টেক করা কয়েনের পরিমাণ।

– স্টেকিংয়ের সময়কাল।

– কিছু ক্ষেত্রে র‍্যান্ডমাইজড অ্যালগরিদম।

উদাহরণস্বরূপ, ইথেরিয়াম 2.0-এ ভ্যালিডেটর হতে হলে ন্যূনতম 32 ETH স্টেক করতে হয়।

3. ব্লক তৈরি ও যাচাই: নির্বাচিত ভ্যালিডেটর নতুন ব্লক তৈরি করে এবং নেটওয়ার্কে ট্রানজ্যাকশন যাচাই করে। অন্যান্য ভ্যালিডেটররা এই ব্লকের সঠিকতা যাচাই করে।

4. পুরস্কার বিতরণ: সফলভাবে ব্লক তৈরি ও যাচাই করার জন্য ভ্যালিডেটররা পুরস্কার হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সি পায়। এই পুরস্কার সাধারণত ট্রানজ্যাকশন ফি এবং নতুন মিন্ট করা কয়েনের সমন্বয়ে গঠিত।

5. শাস্তির ব্যবস্থা (Slashing): যদি কোনো ভ্যালিডেটর দুর্ব্যবহার করে, যেমন ভুল তথ্য যাচাই করে বা নেটওয়ার্কের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তবে তার স্টেক করা কয়েনের একটি অংশ কেটে নেওয়া হতে পারে। এটি নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা বজায় রাখে।

প্রুফ অফ স্টেকের সুবিধা

1. শক্তি দক্ষতা: প্রুফ অফ ওয়ার্কের তুলনায় প্রুফ অফ স্টেক অনেক কম শক্তি খরচ করে, কারণ এটি জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের উপর নির্ভর করে না।

2. দ্রুত ট্রানজ্যাকশন: PoS সিস্টেমে ব্লক তৈরির প্রক্রিয়া দ্রুত হয়, যা ট্রানজ্যাকশন প্রক্রিয়াকরণের গতি বাড়ায়।

3. কম হার্ডওয়্যার প্রয়োজন: PoS-এ ব্যয়বহুল মাইনিং হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন নেই। যে কেউ কয়েন স্টেক করে নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ করতে পারে।

4. নিরাপত্তা: স্টেক করা কয়েনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে নেটওয়ার্কে আক্রমণ করা ব্যয়বহুল, কারণ আক্রমণকারীকে নেটওয়ার্কের বেশিরভাগ কয়েন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

5. অংশগ্রহণ বাড়ায়: PoS সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ সহজ করে, যার ফলে বিকেন্দ্রীকরণ বৃদ্ধি পায়

প্রুফ অফ স্টেকের অসুবিধা

1. ধনী আরও ধনী হয়: যাদের কাছে বেশি কয়েন আছে, তাদের ব্লক তৈরির সম্ভাবনা বেশি। এটি সম্পদের কেন্দ্রীকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

2. নিরাপত্তা ঝুঁকি: কিছু ক্ষেত্রে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নেটওয়ার্কের বেশিরভাগ কয়েন নিয়ন্ত্রণ করে, তবে তারা নেটওয়ার্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি “51% আক্রমণ” নামে পরিচিত।

3. স্টেকিংয়ের জটিলতা: স্টেকিং প্রক্রিয়া এবং ভ্যালিডেটর হওয়ার শর্তগুলো কিছু ব্যবহারকারীর কাছে জটিল মনে হতে পারে।

4. “Nothing at Stake” সমস্যা: কিছু PoS সিস্টেমে, ভ্যালিডেটররা একাধিক ব্লকচেইন ফর্কে কাজ করতে পারে, যা নেটওয়ার্কের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তবে আধুনিক PoS সিস্টেমে (যেমন, ইথেরিয়াম 2.0) এই সমস্যা সমাধানের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা (Slashing) চালু করা হয়েছে ।

প্রুফ অফ স্টেক ব্যবহারকারী ক্রিপ্টোকারেন্সি

বেশ কিছু জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রুফ অফ স্টেক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ:

ইথেরিয়াম (Ethereum 2.0):** ২০২২ সালে ইথেরিয়াম প্রুফ অফ ওয়ার্ক থেকে প্রুফ অফ স্টেকে রূপান্তরিত হয়েছে।

কার্ডানো (Cardano):** Ouroboros নামক একটি PoS প্রোটোকল ব্যবহার করে।

পলকাডট (Polkadot):** Nominated Proof of Stake (NPoS) ব্যবহার করে।

টেজোস (Tezos):** Liquid Proof of Stake ব্যবহার করে।

সোলানা (Solana):** Proof of Stake এবং Proof of History-এর সমন্বয় ব্যবহার করে।

প্রুফ অফ স্টেকের প্রকারভেদ

1. পিওর প্রুফ অফ স্টেক (Pure PoS): এখানে ভ্যালিডেটর নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে স্টেক করা কয়েনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। উদাহরণ: কার্ডানো।

2. ডেলিগেটেড প্রুফ অফ স্টেক (DPoS): এখানে কয়েন ধারকরা তাদের ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যারা ব্লক তৈরি ও যাচাই করে। উদাহরণ: ইওএস (EOS)।

3. নমিনেটেড প্রুফ অফ স্টেক (NPoS): এটি পলকাডট-এ ব্যবহৃত হয়, যেখানে স্টেকাররা ভ্যালিডেটরদের নমিনেট করে এবং পুরস্কার ভাগ করে নেয়।

4. লিকুইড প্রুফ অফ স্টেক (LPoS): এটি টেজোসে ব্যবহৃত হয়, যেখানে স্টেকাররা তাদের স্টেকিং অধিকার অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে পারে।

উপসংহার

প্রুফ অফ স্টেক একটি দক্ষ, পরিবেশবান্ধব এবং বিকেন্দ্রীকৃত ঐকমত্য প্রক্রিয়া যা আধুনিক ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি প্রুফ অফ ওয়ার্কের তুলনায় শক্তি সাশ্রয়ী এবং দ্রুত, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জ, যেমন সম্পদ কেন্দ্রীকরণ, এখনও সমাধানের প্রয়োজন। ইথেরিয়াম 2.0, কার্ডানো, এবং অন্যান্য প্রকল্পের সাফল্য প্রুফ অফ স্টেকের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *